User talk:অসীম চাকমা

From Wikimedia Incubator

Welcome to Wikimedia Incubator!

At the right there are some important links, and here are some tips and info:

If you have any questions, feel free to ask them on Incubator:Community Portal.

-- Welcoming Bot 11:06, 17 November 2015 (UTC)[reply]

বৌদ্ধ ধর্মে দায়কের ভূমিকা[edit source]

সাধনাজ্যোতি ভিক্ষু

যারা বৌদ্ধ কুলে জন্ম গ্রহন করে ভিক্ষুসংঘকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও ঔষধ এ চর্তুপ্রত্যয়াদি দান দিয়ে বুদ্ধ শাসনকে রক্ষা করে বৌদ্ধ সাহিত্যে তারা ‘দায়ক’ নামে অভিহিত হন। অন্যথা বৌদ্ধ কুলে জন্ম গ্রহনের দ্বারা কেউ ‘দায়ক’ আখ্যার অধিকারী হন না। এখন প্রশ্ন হল প্রকৃত দায়ক কে? দায়ক : ‘√দা + ণক’ প্রত্যয়ে ‘দায়ক’ শব্দের উৎপত্তি। ‘√দা= দানে’ অতএব, দায়ক অর্থ দাতা, গৃহী যশমানে নয়। ‘√দা হতে “দাতি” ও ‘দেতি’ এ দুটি ক্রিয়া হয়। দাতী’তি লুনাতি- ছিন্দানি। ছেদন করে। দান চিত্তের মাৎসর্য, লোভ, দ্বেষ ও মোহাদি পাপধর্ম ছেদন করে। দেতী’তি উপ্পাদেতি- বড্েঢতি। উৎপন্ন ও বর্ধন করে। দান চিত্তের উদারতা, প্রশস্ততা, মহত্ত্ব, মৈত্রী, করুণা, অলাভ, অদ্বেষ ও অমোহাদি কুশল ধর্ম উৎপন্ন ও বর্ধন করে। কেবল পড়ার দ্বারা পড়ুয়া ছেলে হয় না, তাকে পড়তে, বলতে ও লেখতে হয়। যেহেতু “পড়ায় পূর্ণ, বলায় প্রস্তুত এবং লেখায় খাঁটি মানুষ হয়। সেরুপ দায়কের কর্তব্য পরিপূর্ণ হয় দানে, সেবায় ও আপদে-বিপদে রক্ষায়।

অবস্থা ভেদে দায়ক তিন প্রকার। যথা- দানদাস, দানসহায় ও দানপতি। দানদাস : যে নিজে ভাল খায়, অথচ অপরকে দেওয়ার সময় খারাপ দেয়, তাকে বলে দানদাস। দানসহায় : সে নিজে যেমন খায়, অপরকেও দিতে তেমন দেয় তাকে বলে দানসহায়। দানপতি : যে ব্যক্তি নিজে কোন প্রকারে জীবন যাপন করে, অথচ দানের বেলায় যথা সম্ভব উৎকৃষ্ট বস্তুদান করতে চেষ্টা করে তাকে দানপতি বলা হয়। (বুদ্ধের জীবন ও বাণী- শ্রীমৎ ধর্মদীপ্তি স্থবির- ৭১পৃষ্ঠা)। জনৈক এক বিহার কমিটির সভাপতি বলে থাকেন, থাগা বা দায়ক দুই প্রকার। যথা - খ্যায়াং থাগা আর খ্যায়াং থগা বা দায়ক। খ্যায়াং থাগা বা দায়ক : যে ব্যক্তি নিজে কোন প্রকারে জীবন যাপন করে, অথচ দানের বেলায় যথা সম্ভব উৎকৃষ্ট বস্তুদান করতে চেষ্টা করে, পালা সোয়াং আসলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে, কিভাবে ভালো সোয়াং বা পিন্ড দেয়া যায়, তাকে খ্যায়াং থাগা বা দায়ক বলা হয়। খ্যায়াং থগা বা দায়ক : যে নিজে ভাল খায়, অথচ অপরকে দেওয়ার সময় খারাপ দেয়, নিঃকৃষ্ট বস্তুদান দেয়, পালা সোয়াং আসলে পালা কোন রকম ঘুরাতে পারলেই হলো, ভিক্ষুরা খেতে পারলো কি, না পারলো সে চিন্তা করে না, এভাবে বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন ভাবে থগায় বা ফাঁকি দেয়, তাকে বলে খ্যায়াং থগা বা দায়ক।

অন্ন, বস্ত্র, শয়নাসন এবং ঔষধ পথ্যকে অবলম্বন করে প্রতিটি মানুষ বেঁচে থাকে। ভিক্ষুদের ব্যবহৃত উক্ত বস্তুকে চর্তুপ্রত্যয় বলা হয়। পূণ্যাকাঙ্খী ও বুদ্ধ শাসন রক্ষাকামী যে কোন নর বা নারী আপন যোগ্যতানুযায়ী কোন এক বা অধিক ভিক্ষুর এক বা অধিক প্রত্যয়ের দায়ক হতে পারেন। চর্তুপ্রত্যয়ের মধ্যে ভিক্ষুর প্রতিদিন প্রয়োজন পিন্ডপাত বা আহার। অরুণোদয় হতে দিন বারটার মধ্যে ভিক্ষুগণ যা আহার করেন তাকে ‘পিন্ডপাত’ বলা হয়। গৃহীরা দিনে রাতে অন্তত দুবার জলযোহ ও দুবার আহার করেন। আর ভিক্ষুরা সকালে একবার প্রাতঃরাশ (পুত্যা সিয়ং) ও বারটার আগে মধ্যহৃ ভোজন (দুপুজ্যা সিয়ং) একবার আহার করেন।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে যে, বর্তমানে প্রাতঃরাশ বা ‘পুত্যসিয়ং’ শব্দটি ব্যবহারিক অর্থে অপব্যবহার দেখা যায়। বিশেষ করে এক শ্রেণী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ও তাদের ভক্তবৃন্দের কথোপকথনে। সকালের প্রাতঃরাশকে ‘পানীয়’ বলে আখ্যায়িত করে থাকে। অর্থাৎ পানীয় (প্রাতঃরাশ)। অথচ, আমরা যুগ যুগ ধরে প্রাতঃরাশকে (পুত্যা সিয়োং) বলে থাকি। এই বিষয়টি বর্তমানে বিতর্কিত করা হচ্ছে। আমরা ‘পানীয়’ শব্দটি বিশ্লেষন করলে পাই, পানীয় শব্দের ইংরেজী শব্দ হচ্ছে Drinking- যার অর্থ হচ্ছে, যা পান করার যোগ্য। পান করা যায় এমন বস্তু, যা চিবিয়ে খেতে হয় না। পানীয়, সরবত এগুলো সমার্থক শব্দ। তাহলে দেখুন প্রাতঃরাশ বা খাদ্যভোজ্যকে ব্যবহারিক অর্থে ‘পানীয়’ বলা মানেই সুস্থ মস্তিষ্কে ডাহা মিথ্যা কথা বলার সামিল। অথচ প্রতিদিন পঞ্চশীল শিক্ষা দেয় বা গ্রহন করে যে মিথ্যা কথা বলবে না বা বলব না। সুর্য পুর্বদিকে উঠে ও পশ্চিম দিকে অস্ত যায় না বলে, সুর্য পশ্চিম দিকে উঠে এবং পূর্বে দিকে অস্ত যায় বলার সামিল। অথচ ভিক্ষু পাতিমোক্ষে মুসাবাদা অংশে বলা হয়েছে যে, স্বজ্ঞানে মিথ্যা বললে পচিত্তিয়া আপত্তি হয় ( ভিক্ষুদের বেলায়)। তারা এর কোন তোয়াক্কা করে না।

এবার আলোচ্য প্রসঙ্গে আসা যাক, যে ব্যক্তি প্রতিদিন একজন ভিক্ষুর পিন্ডপাত দেন, তিনি সেই ভিক্ষুর পিন্ডপাত দায়ক মাত্র। সেই পিন্ডপাত শতজনকে যদি ভাগ করে দেন তাহলে প্রত্যেকে সে ভিক্ষুর এক প্রত্যয়ের (পিন্ডপাতের) শতভাগ দায়ক। চাকমা সমাজে অন্ধ প্রথানুসারে গ্রামবাসী ধনী-দরিদ্র সকলে মিলে পালাক্রমে এক সেবকসহ এক ভিক্ষুর আহার দেয়। এক বিধবা দরিদ্র নারী যেমন পালাক্রমে একবার পিন্ড দেয়, তেমনি ধনীও। এতে ধনী ব্যক্তি যে দায়ক হিসেবে বিবেচিত তেমনি দরিদ্র বিধবা ও একই ভাবে বিবেচিত। এখানে দেখা যায় দরিদ্র বিধবা হতে অধম সে ধনী ব্যক্তি, জ্ঞানের অভাবে সে সত্য বুঝতে পারে না। পাঁচ বৎসর ছেলে যদি প্রথম শ্রেনীতে পড়ে এবং বিশ বৎসরের যুবক যদি সেই শ্রেণীতেই পড়ে, দুজনের মধ্যে কে অধম? কে নিন্দনীয়?

একথা অপ্রিয় সত্য হলেও বলতে হয়, এ এক বেলা পিন্ডদানের জন্য অনেক দায়ক ভিক্ষুকে ইচ্ছা মতো কথায় কথায় পরিচালনা করতে চায়। তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ভিক্ষুর উপর চাপিয়ে দিতে চায়। ভিক্ষু দায়কের কথার মতো চলতে না পারলে বিহার থেকে তাঁড়িয়ে দিতে উদ্যত হয়। পালা সোয়াং বন্ধ করে দেয়। এ এক বেলা সোয়াং এর জন্য ভিক্ষু দায়কের নিকট জিম্মি হয়ে যায়। তারা মনে করে আমরা পিন্ডদান করছি ভিক্ষু কেন আমাদের কথার মতো চলবে না? অথচ পিন্ডদান বা দান-ধর্ম করছি নিজের প্রয়োজনে ইহ-পারলৌক সুখ-শান্তির জন্য, তা জানে না। আবার এ কথাটি জানে না যে বিহার থেকে ভিক্ষুকে তাঁড়িয়ে দিতে চায় সেটি “ ইমং চতুদ্দিস্সস আগতানাগতস্স ভিক্খূ সঙ্ঘস্স দেম সঙ্ঘো যথাসুখং পরিভূঞ্জতু” বলে ভিক্ষুসংঘকে দান করেছেন। তাদের যে, ভিক্ষুকে তাঁড়িয়ে দেয়ার অধিকার নেই তা জানে না। এ সব ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন বোধ করছি। বিহার দায়কের দানীয়, বিহার প্রাঙ্গণ ও বিহারের সম্পত্তি ভোগ করলে সংঘ সম্পত্তি চুরি ও ডাকাতি করার অপরাধে অপরাধী হয়। ধর্মতঃ রক্ষা করার অধিকার আছে বটে, কিন্তু ভোগ করার অধিকার নেই। এমন কি আমার বিহার বলারও দায়কের অধিকার নেই, তাতে পাপ আছে। কারণ এগুলো দানীয় সম্পত্তি। বিহার প্রাঙ্গণের গাছ, ফল, এমনকি ঘাস পর্যন্ত সংঘের অধিকারে গরু-ছাগলের দ্বারা খাওয়ালে তাহাও অপরাধের গণ্য হয়। বিনিময়ে গ্রহন করা যেতে পারে বটে, কিন্তু বিহার দায়কের পক্ষে তাও অন্যায়। কারণ এতে ক্রমশঃ লোভ, দ্বেষ, মোহ ও আমিত্ব ভাব এসে পড়ে। (সদ্ধর্ম রত্ন চৈত্য- শ্রীমৎ জিনবংশ মহাস্থবির- ১২০পৃষ্ঠা )।

ছাত্র বিদ্যালয় ত্যাগ করলে যেমন সে আর সে বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকে না: তেমনি দায়কের কাজ ত্যাগ করলে তিনি আর দায়ক থাকেন না। দায়ক সম্পর্কে সত্য জ্ঞান লাভ হলে ‘আমরা বনদায়ক ও আমরা পার্বত্য দায়ক এ অজ্ঞতা সুর্যোদয়ের অন্ধকার বিনাশের ন্যায় ধ্বংস প্রাপ্ত হবে। এই ভ্রান্তধারণা সুদীর্ঘ কাল হতে আমাদের চাকমা সমাজে মহাঅনিষ্ট করে এসেছে। সেই মিথ্যাদৃষ্টি পূণ্যকামী মানুষের পূন্য-সঞ্চয়ের যেমন বাধাঁ দিয়েছে তেমনি সমাজকে অবনত করে রেখেছে। সেই মহাপাপ সমূলে বিনষ্ট হলে সমাজ, ধর্মীয় ব্যাপারে শীঘ্রই অগ্রগতি লাভ করবে। উদাহরণ স্বরুপ একটি ঘটনা বলতে বাধ্য হলাম যে, চট্টগ্রাম শহরে শিল্প এলাকায় এক ব্যক্তি নবগ্রহ বা নবরত্ন সূত্র শ্রবণ করবে বলে, আমাকে ফাং করা হল, আমি বললাম- জায়গা তো ভালভাবে জানিনা, আমাদেরকে একটু নিতে আসলে ভালো হয়। সে বললো ভন্তে! আমরা একটু কাজে ব্যস্ত থাকবো আপনারা বাসার পাশে আসলে আমরা গিয়ে নিয়ে আসব। আমরাও যথা সময়ে গিয়ে কোন রকম বাসা খুঁজে নিয়ে আসনে বসে পড়লাম। ততক্ষণে বনবিহারের ভিক্ষুরা আসেনি। জানতে পারলাম তাদেরকে নিয়ে আসার জন্য একটা টেক্সী নিয়ে দুবার আনতে যেতে হয়েছে। এবার দেখুন যে জায়গায় আমাদেরকে নিয়ে আসতে একবারও সময় পায়নি।

যাই হোক, যথা নিয়মে সূত্র পাঠ শেষ করার পর যে যার বিহারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। অনেক চেষ্টা করে একটা টেক্সী নিয়ে আসা হল, তখন আমি বড়গাং বিহার থেকে আগত ভিক্ষুদের বললাম- তোমরা আগে যাও, যেহেতু অনেক দুর থেকে এসেছ, তারপরও কর্ণফুলী নদী পার হতে হবে, রাত হয়ে যাচ্ছে। তখন এক জন দায়ক বললো- এটা বনবিহারের ভিক্ষুদের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। তখন আমি তাকে বললাম- তাদের তো মন্দির কাছে, তারা তো একটু পরেও যেতে পারবে। বড়গাং বিহার থেকে আগত ভিক্ষুদের আগে যাওয়া দরকার যেহেতু অনেক দুর থেকে এসেছে তারপরও গাঙ পার হতে হবে। সে ব্যক্তি না চোর বান্দা। তখন আমি ভিক্ষুদের বললাম- চলো সামনে গিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যাব। তারা অনেক কষ্ঠ করে একটি টেক্সী নিয়ে চলে গেল, আমিও একটি রিক্সা করে বিহারে চলে আসলাম। এটি বলার কারণ হলো দেখুন সাধারণ দায়কদের কিরুপ পার্বত্যভিক্ষু ও বনভিক্ষু বিভাজনের মনোভাব। এমনকি অনেক দায়ক ভিক্ষুকে জিজ্ঞাসা করতে দেখেছি, আপনি পার্বত্য ভিক্ষু না বনভিক্ষু? ভিক্ষুদের চেয়ে সাধারণ লোকদের কিরুপ বন ও পার্বত্যভিক্ষু ভাগ করে থাকে। তাহলে বন ও পার্বত্যভিক্ষূ বিভক্তি বাড়বে না কেন? সাধারণ দায়কেরা চাইলে এ বিভক্তি অনেকটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হতো। এগুলো কি দায়কের করনীয় কর্তব্য নয় কি? দায়কেরা যদি এরুপ করলে সে কি আর দায়ক থাকবে? এরুপ হলে সমাজ ও স্বদ্ধর্ম কিভাবে উন্নতি সাধন হবে?

ছাত্র যেমন আপন যোগ্যতানুসারে প্রথম শ্রেণী হতে ক্রমে ক্রমে এম.এ শ্রেণীতে পড়ে, তেমন পুণ্যকামী ও শাসনহিতকামী শ্রদ্ধাবান নরনারী আপন যোগ্যতানুযায়ী ভিক্ষুর দায়ক হন। বৌদ্ধ-অবৌদ্ধ পুণ্যকামী ব্যক্তি অতীতে ভিক্ষুর দায়ক ছিলেন এবং বর্তমানেও আছেন। ভিক্ষুদের সেবায় বা খাবার দানের ফল সম্পর্কে আমরা জানতে পারি পুর্ণ শ্রেষ্ঠীর জীবন কাহিনী হতে। পুর্ণ গরীব হলেও সৎ ও পুন্যবান ছিলেন। সে এক সময় সদ্য সমাপত্তি ধ্যান থেকে উত্থিত সারিপুত্র স্থবিরকে পিন্ডদান করেছিলেন। সেই দানে দৃষ্টধর্ম বেদনীয় ফল লাভ করে। এই দানের ফলে তার হাল কর্ষণের মাটি পর্যন্ত স্বর্ণে পরিণত হয়েছিল। রাজা এ খবর জ্ঞাত হয়ে জমি হতে সমস্ত স্বর্ণ তুলে নিয়ে এসে পুর্ণকে শ্রেষ্ঠী উপাধি প্রদান করে রাজ্যের একটা অংশে জায়গা দিয়ে প্রাসাদ তৈরী করে বসবাস করার সুবন্দোবস্ত করেন। এই প্রাসাদ তৈরী করার সময়ও মাটির নীচ থেকে চারি নিধি কুম্ভ প্রাপ্ত হয়। তাহলে দেখুন এক বেলা পিন্ড দানও জীবনের গতি বদলে দিতে পারে, যদি সে দান ত্রিচেতনা (পূর্ব চেতনার, মুঞ্চন চেতনা, অপর চেতনা) সমন্বিত হয়ে শ্রদ্ধার সহিত হয়। আমাদের সমাজে দেখা যায়, পালা সোয়াং দিতে গেলে বিহারের সেবককে গিয়ে নিয়ে আসতে হয়, সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারে না, তাই ভোরের সোয়াং দিতে পারব না, ইত্যাদি বলে নানা অজু হাত দেখায়। এগুলো যত দিন থাকবে ততদিন প্রকৃত দায়ক হওয়া কখনও সম্ভব নয়, ফল পাওয়া তো দূরের কথা।

এখানে শ্রদ্ধা শব্দটি ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন বোধ করছি। কর্ম ও কর্মফলকে বিশ্বাস করার নাম শ্রদ্ধা। শীলবানদের দর্শনের ইচ্ছা, সদ্ধর্ম শ্রবণের ইচ্ছা ও পাপ ময়লা ত্যাগের ইচ্ছার নাম শ্রদ্ধা। যে শ্রদ্ধায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভিক্ষু শ্রামণদের সেবা করে, দীন, দুঃখী, পথিক ও ভিখারীদের উপকার করে সে শ্রদ্ধা চার প্রকার। যথা- আগম, অধিগম, অবকপ্পন ও প্রসাদ। আগম : বোধিসত্বগণের বুদ্ধত্ব প্রার্থনায় সময় হতে যে শ্রদ্ধা অবিচলিত থাকে তাই আগম শ্রদ্ধা। অধিগম : আর্য শ্রাবকগণ যে শ্রদ্ধাবলে লোকোত্তর ধর্ম লাভ করেন, সে শ্রদ্ধার নাম অধিগম শ্রদ্ধাবলে। অবকপ্পন : বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ এ শব্দত্রয়ের শ্রবণ করা মাত্র যে অচলা শ্রদ্ধার উদয় হয় তাকে অবকপ্পন শ্রদ্ধা বলে। প্রসাদ : যে চিত্তের প্রসন্নতা উৎপাদন করে তাকে প্রসাদ শ্রদ্ধা বলে। (সদ্ধর্ম রত্নচৈত্য- শ্রীমৎ জিনবংশ মহাস্থবির- ৩৬৭পৃষ্ঠা)।

মিলিন্দ প্রশ্ন গ্রন্থে রাজা মিলিন্দ ও ভিক্ষু নাগসেন কথোপকথনে জানা যায় । রাজা বললেন, “ভন্তে নাগসেন। শ্রদ্ধার লক্ষণ কি?” “মহারাজ! চিত্তের প্রসন্নতা সাধন ও উৎসাহ উৎপাদন হচ্ছে শ্রদ্ধার লক্ষণ।” “ভন্তে চিত্তের প্রসন্নতা সাধন কিভাবে শ্রদ্ধার লক্ষণ হয়?” “মহারাজ! চিত্তে শ্রদ্ধার উৎপন্ন হলে পঞ্চনীবরণ (বাধা) সমূহ বিদূরিত হয়, নীবরণহীন চিত্ত স্বচ্ছ, প্রসন্ন ও নির্মল হয়। এরুপেই মহারাজ! চিত্তের প্রসন্নতা সাধন শ্রদ্ধার লক্ষণ।” “ভন্তে মনে উৎসাহ সৃষ্টি কিভাবে শ্রদ্ধার লক্ষণ হয়?” “যেমন মহারাজ! কোন যোগী অপর সাধকের চিত্তকে বিমুক্ত দেখে স্বয়ং স্রোতাপত্তি ফল, সকৃদাগামী ফল, অনাগামী ফল, কিংবা অর্হত্ব পদের জন্য আশ্বস্ত ও উৎসাহিত হয় এবং অপ্রাপ্তির নিমিত্ত, অনুপলদ্ধির উপলদ্ধির নিমিত্ত, অপ্রত্যক্ষের-প্রত্যক্ষের নিমিত্ত আত্মনিয়োগ করেন এরুপেই মহারাজ! মনে উৎসাহ সৃষ্টি শ্রদ্ধার লক্ষণ। (মিলিন্দ প্রশ্ন- শ্রীমৎ ধর্মাধার মহাস্থবির- ৬৩পৃষ্ঠা)।

অতীতে ভারতের ন্যায় বর্তমান বৌদ্ধ প্রধান দেশ শ্রীলংকা, বার্মা ও শ্যাম বা থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশে যথেষ্ট দায়ক আছেন বলে বিপুল সংখ্যক ভিক্ষুও ঐ সব দেশে বর্তমান। যার ফলে ঐ সব দেশে নভোমন্ডলে পূর্ণচন্দ্রের মত বৌদ্ধধর্ম এখনও দীপ্তিমান। ব্রহ্ম ও শ্যাম দেশে ভিক্ষার প্রথা আছে; কিন্তু বিশিষ্ট ভিক্ষুদের দায়ক আছেন। তাঁদের ভিক্ষায় যেতে হয় না। শ্রীলংকায় ভিক্ষা প্রথা নেই। যোগ্য গৃহীরাই দায়ক হয়ে ভিক্ষুসংঘ ও বুদ্ধশাসন রক্ষা করেছেন। যাঁরা মাসিক টাকা দিয়ে দায়ক হন, তাদেঁর মধ্যে ব্যবসায়ীরা প্রতিমাসের প্রথম দিন এবং চাকুরী জীবিগণ বেতন পেলেই সর্ব প্রথম তাদেঁর স্বীকৃত টাকা বিহারে দিয়ে যান। সেই টাকা আনবার জন্য ভিক্ষু, শ্রমণ বা চাকর তাদের নিকট যান না। এজন্য চাকরের উপস্থিতিও তাঁদের পক্ষে অপমানজনক এবং তাঁদের পূন্যেরে লাঘবতা মনে করেন না। যে সব পরিবেশে বহু ভিক্ষুর বাস নিকটে এবং দূরের ধনী ব্যক্তিগণ প্রতি মাসের নির্দিষ্ট তারিখে এক বা একাধিক দিন তাঁদের খাদ্য দেন। অবশিষ্ট দিনের জন্য কাছের এবং দূরের মানুষেরা বাস ভাড়া করে পূর্বদিন বিকালে বিহারে উপস্থিত হন। রাত্রে ধর্মদেশনা শুনে পরদিন দান দিয়ে আহারের পর চলে যান। এভাবে শ্রীলংকা বাসী ভিক্ষু সংঘ, বুদ্ধ শাসন রক্ষা করে আসছে।

দানের ফল সম্পর্কে বলা হয়েছে, সরিষা প্রমাণ বীজ হতে মহান্যাগ্রোধবৃক্ষ উৎপন্ন হয়ে শত শত শাখা-প্রশাখায় যেমন নীলাকাশ ঢেকে ফেলে এবং অসংখ্য ফল প্রদান করে তেমন অল্প পুণ্যও বিপুল ফল প্রদান করে এ সত্য উপলদ্ধি করতে পেরে জ্ঞানী ব্যক্তি অল্প পুণ্যকে অবজ্ঞা করেন না। দায়ক প্রতিগ্রাহককে খাদ্যের সঙ্গে আয়ু, বর্ণ, সুখ, বল ও প্রজ্ঞা এই পাঁচটি সম্পত্তি দিয়ে থাকে। ঐ দানের ফলে দায়ক দেব-মনুষ্যলোকে ভোগ সম্পত্তি ও ঐ পঞ্চ সম্পদের অধিকারী হয়। কৃপন মানুষ তার মাৎসর্যযুক্ত অকুশল চিত্তের প্রভাবে ইহজীবনে সকলের নিন্দনীয় হয় এবং মৃত্যুর পর চর্তুবিধ অপায়ের যে কোন একটিতে উৎপন্ন হয়। যদি মানুষ হয়, অতি গরীব ও অনাথ হয়। দারিদ্র মানব জীবনের বড় অভিশাপ। দানের ফলে মানুষ ভোগশালী হয়। দায়ক মৃত্যুর পর সুখ-স্বর্গ উৎপন্ন হয়।

বুদ্ধের সমকালীন এক গরীব বিধবা কাঠ কেটে মা-মেয়ে জীবন যাপন করত। সে বিধবাও এক তরুণ ভিক্ষুকে নিকস্থ পাহাড়ে এক কুটির নির্মাণ করে দিয়ে বর্ষায় তিন মাস তাঁকে আহার ও প্রয়োজনীয় দ্রব্য দিয়ে সেবা করেছিলেন। বর্ষার তিনমাস পরে সে ভিক্ষু অর্হত্ব ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে শ্রাবস্তীতে বুদ্ধের নিকট চলে যান। পূণ্যকামী পরমার্থ মানবই ভিক্ষুর দায়ক হয়ে বুদ্ধশাসন রক্ষার হেতু হতে পারেন। এক জন নারী বা পুরুষ যদি একজন ভিক্ষুরও চর্তুপ্রত্যয়ের দায়ক হন, উক্ত ভিক্ষু সে দায়ককে অবলম্বণ করে নিশ্চিন্তে ধ্যান-সাধনা বা জ্ঞান সাধনা করতে পারেন। অথবা অন্য ভিক্ষু-শ্রমণ ও গৃহীকে ধর্ম শিক্ষা দিয়ে কিংম্বা সামাজিক ও ধর্মীয় কাজে গৃহীদেরকে সাহায্য করে নিজের এবং মানব সমাজের অপ্রমেয় হিতসাধন করতে পারেন। তিনি দায়ক হয়ে ভিক্ষুকে রক্ষা করেছেন বলে অন্যান্য অনেক ভিক্ষুকে দান দিয়ে তাঁর নিকট ধর্মশ্রবণ ও ধর্মালোচনা করে এবং আরও নানাভাবে পুণ্য ও ধর্মজ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হন। ভিক্ষুও ঐসব কাজ সহজে করতে পারেন। অতএব সে দায়ক ও দায়িকা মানব-সমাজের অজ্ঞানান্ধাকার বিনাশ, প্রজ্ঞালোক উৎপাদন, বিপুল পুণ্যবর্ধন এবং বুদ্ধশাসনের স্থিতি ও বর্ধনের প্রধান সহায়ক হন। সে দায়ক বা দায়িকা বিশেষ ধনী এবং শিক্ষিত না হলেও তাঁর ঐ কাজের দ্বারা তিনি বর্তমান জীবনে অন্য অধিকতর ধনী এবং শিক্ষিত হতে মহৎ ও শ্রেষ্ঠ। তাঁর সে কাজের দ্বারা তিনি মানব-সমাজে শ্রেষ্ঠ আর্দশ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁকে অনুসরণ করে অন্য মহত্ত্বকামী নর ও নারী তেমন মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হতে পারেন। এটিই দায়কের গৌরব ও বৈশিষ্ট্য। এই তাঁর উত্তম আতœপ্রসাদ। দায়কের ইহজীবনে বহু প্রত্যক্ষ ফলের মধ্যে এটি অন্যতম।

আমরা জানি যুগে যুগে বৌদ্ধশাসন প্রসারিত ও স্থায়িত্ব হয়েছিল অগ্গা চক্ক ও ধম্মচক্ক সমন্বয়ে। এখানে অগ্গা চক্ক বলতে বৌদ্ধ জনসাধারণকে আর ধম্মচক্ক বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘকে বুঝানো হয়েছে। ভিক্ষু ও দায়ক একের অপরের পরিপূরক। উভয়ের সমন্বয়ে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার-প্রচার ঘটবেই। বৌদ্ধ জনসাধারণের দায়িত্ব হলো ধর্মের প্রসার-প্রচারের জন্য যথাসাধ্য পৃষ্ঠপোষকতা করা। ভিক্ষু সংঘের দায়িত্ব ধর্মকে দিকে দিকে প্রসার-প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা। যেমন বুদ্ধের সময়কালে রাজা অজাতশক্র, বিশাখা, অনাথপিন্ডিক শ্রেষ্ঠী, প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা না করতেন তাহলে বৌদ্ধ ধর্ম এতটুকু প্রসারিত হত না। এর একশত বছর পর সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করে আরো দিকে দিকে প্রসারিত করেন। অনুরুপভাবে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার, প্রচার ও রক্ষার্থে বৌদ্ধ জনসাধারণ পৃষ্ঠপোষকতা করে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

পরিশেষে বলা যায় যে, দায়কদের কতগুলো ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অনর্থক পার্বত্য-বনভিক্ষু বলে বিভাজন করে অকুশল কর্ম সম্পাদন করে সমাজে ক্ষতি করবেন না। বৌদ্ধ ভিক্ষু ভিক্ষুই। এদের সম্মাণ, শ্রদ্ধা করা এবং চর্তুপ্রত্যয়াদি দিয়ে সেবা করা আমাদের কর্তব্য। তবে অন্ধভাবে ধর্মকে লালন-পালন করবেন না। ধর্ম শুনতে বা শিখতে হবে, ধারণ করতে হবে, আচরণ বা পালন করতে হবে। তবেই ধর্ম পালনের স্বার্থকতা আসবে। অতএব আমাদের আদিবাসী বৌদ্ধদের মাঝে বৌদ্ধিক চিন্তা, চেতনার উদয় হোক এ কামনায়।

লেখক পরিচিতি : বি.এ (অনার্স) এম. এ, এম. এড, অধ্যক্ষ, হিলচাদিগাং বৌদ্ধ বিহার, সাধারণ সম্পাদক, পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন, খাগড়াছড়ি, সম্পাদক, হিলচাদিগাং (ধর্মীয় ও সামাজিক মুখপত্র)।